চাকমাদের সর্ববৃহৎ ও প্রধান সামাজিক উৎসব বিঝু। এ উৎসব চাকমাদের জাতীয় জীবনের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। অথচ এ উৎসবের নামকরণ ও পালনে দেখা দিয়েছে গোঁজামিল। এ উৎসবের নাম অনেকে লিখে বিজু, অনেকে লিখে বিঝু। বিশেষ করে ২০১৯ সালে এই বিতর্ক নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়া ফেসবুকে লেখালেখি হয়। কিন্তু বানানের এ গোঁজামিলের সূত্রপাত অনেক বছর আগে হয়েছিল। তাই, এ বিষয়ে আলোকপাত করার চেষ্টা করছি।
বিঝু উৎসব ঠিক কখন থেকে শুরু হয়েছে স্পষ্ট করে বলা না গেলেও এ উৎসব যে অনেক প্রাচীন তা অনুমেয়। এ উৎসবের সাথে চাকমাদের জীবন-যাপনের সম্পর্ক অত্যন্ত ঘনিষ্ট। শুধু তাই নয় এর সাথে রয়েছে লোকবিশ্বাস ও মৈত্রীর এক গভীর সম্পর্ক। চাকমারা যেখানে থাকুক না কেন বিঝু আসলে হৃদয়ে খুশির হাওয়া বয়ে যায়। বিঝু উপলক্ষে আগাম প্রস্তুতি নিয়ে কয়েকদিন ধরে খেলাধুলা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। চাকমা খেলাধুলার মধ্যে ঘিলে খারা (ঘিলা খেলা), ন্হাদেং খারা (লাটিম খেলা), পাক্খোন খারা, পুত্তি খারা, বলি খারা (বলী খেলা), কাত্থোল খারা, বাচ খরম দুমুর (বাঁশ খরম দৌড়) প্রতিযোগিতা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে বাঝি, ধুধুক, সিঙে, খেংগরং ইত্যাদি বাদ্যযন্ত্র বাজানো হয়। যদিও বর্তমানে উন্নত প্রযুক্তির ছোঁয়াই এগুলো প্রায় হারিয়ে যেতে বসেছে, তথাপি বিঝু আসলে এখনো পর্যন্ত এ সমস্ত জিনিসপত্র দেখা যায়।
বিঝুর বিশেষত্ব হলো বছরে মাত্র একবার এ উৎসব হয়ে থাকে। ঐতিহ্যগতভাবে বিঝু তিন দিন ধরে পালিত হয়ে থাকে- ফুল বিঝু, মুল বিঝু ও গজ্যেপজ্যে দিন। এ বিষয়ে বিস্তারিত ধারাবাহিকভাবে আলোচনা করা হবে।
বিজু নাকি বিঝু :
প্রথমে উচ্চারণের কথাই ধরা যাক। চাকমারা কোনকালে ‘বিজু’ উচ্চারণ করে নি, উচ্চারণ করে বিঝু। তবে, বাংলা বর্ণমালা দিয়ে ‘বিঝু’ লিখে কাছাকাছি উচ্চারিত হলেও শুদ্ধ চাকমা উচ্চারণ আসে না। কারণ, চাকমাদের 𑄏-এর উচ্চারণ হচ্ছে ঘোষ ঘর্ষণজাত দন্তমূলীয় মহাপ্রাণ (voiceless fricative alveolar aspirated) ধ্বনির। আর বাংলার ‘ঝ’ হচ্ছে তালব্য-দন্ত্যমূলীয় স্পৃষ্ট মহাপ্রাণ (Plato-alveolar Plosive aspirated) ধ্বনির। বাংলায় “ঝাকে ঝাকে” উচ্চারণ করতে যতটা জোর দিতে হয় চাকমায় “ঝাগে ঝাগে” উচ্চারণ করতে ততটা জোর দিতে হয় না। তারপরও ‘বিঝু’ লেখাটাই যুক্তিযুক্ত। কারণ, চাকমার ‘𑄏’ আর বাংলার ‘ঝ’ উভয়ই মহাপ্রাণ ধ্বনির বর্ণ। কিন্তু মহাপ্রাণ ধ্বনির স্থলে অল্পপ্রাণ ধ্বনির বর্ণ জ/𑄎 দিয়ে লিখলে অশুদ্ধ উচ্চারণ আসবে। আর যদি বিঝু শব্দের তুলনামূলক বিশ্লেষণ করি তাহলে দেখা যায়- কোনো কোনো পণ্ডিতের মতে সংস্কৃত ‘বিষুবত’ শব্দ থেকে অহমীয়ার ‘বিহু’ শব্দের উদ্ভব হয়েছে। অহমীয়াদের কাছে এ উৎসবের নাম ‘বিহু’, ত্রিপুরাদের কাছে ‘বৈসু’, তঞ্চঙ্গ্যাদের কাছে ‘বিষু’, চাকমাদের কাছে ‘বিঝু’ নামে পরিচিত। এগুলোকে সমজাতীয় শব্দ বলা যায়। দেখতে পাচ্ছি- একাক্ষর বিশিষ্ট এ শব্দগুলোর শেষে মহাপ্রাণ ধ্বনি পাওয়া যাচ্ছে। বিহু’র হ, বৈসু’র স, বিষু’র ষ ও বিঝু’র ঝ মহাপ্রাণ ধ্বনি। অতএব, ‘বিজু’ নয় ‘বিঝু’ লেখাটাই যুক্তিযুক্ত। বাংলা বানান অনুযায়ী বিঝু’র বানান হয় Bijhu, কিন্তু চাকমা উচ্চারণ ও বানান অনুযায়ী Bizhu লিখতে হয়। কারণ, International Phonetic Alphabet-IPA তে চাকমা 𑄎 এর উচ্চারণ অনুযায়ী প্রতিবর্ণ z, আর তারই মহাপ্রাণরূপ 𑄏 এর প্রতিবর্ণ হয় zʰ অথবা zh. সেহেতু শুদ্ধ চাকমা উচ্চারণ অনুযায়ী লিখতে চাইলে ইংরেজিতে অবশ্যই Bizhu লিখতে হবে, Biju বা Bizu নয়।
ফুল বিঝু (Phul Bizhu) :
দীর্ঘকাল থেকে চাকমারা জুম চাষের উপর নির্ভরশীল ছিল। জুম চাষ যেহেতু উঁচু জায়গায় বা পাহাড়ে করা হয় সেহেতু সেখানে ছড়া-ছড়ি থাকা স্বাভাবিক। পাহাড়ের পাদদেশ থেকে পানি প্রবাহিত হয়ে সৃষ্টি হয় ঝর্ণা। ঝর্ণার জীবিতাবস্থায় ছড়া বা ছোট নদীর অস্তিত্ব থাকে। সেই পাহাড়ী ঝর্ণা ও ঝর্ণা থেকে সৃষ্ট ছোট নদী তাদের পানির অভাব পূরণের প্রধান উৎস। মিথ অনুসারে পানির দেবতাকে কৃতজ্ঞতা জানানোর জন্য গঙা মা বা জলদেবীর উদ্দেশ্য করে ছড়া পাড়ে বা গাঙের তীরে কলাপাতায় ফুল রেখে তার উপর তেলচাদি (বাঁশের কুপি) জ্বালিয়ে প্রণাম জানানো হয়। এ রীতি অবশ্যই তান্ত্রিক সমাজে বিশেষ কোন উৎসব হিসেবে নয় বরং পূজা হিসেবে পরিগণিত হয়। এ রীতির পরিসর যখন বৃহদাকার ধারণ করে তখন সেটা আর পূজার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে না, হয়ে ওঠে দারুন এক উৎসব। নামকরণ হয় ফুল বিঝু। বিঝু উৎসবের তিন দিনের মধ্যে ফুল বিঝু প্রথম দিন। ফুল বিঝু শুরু হয় বসন্তের শেষদিকে। বাংলা ক্যালেন্ডার অনুযায়ী চৈত্র মাসের ২৯ তারিখ অর্থাৎ বছর শেষ হওয়ার একদিন আগে। ঐদিন খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠে আনন্দের সহিত হরেক রকমের ফুল তোলা হয়। উল্লেখ্য যে, ঐসময় বাড়ির আঙ্গিনায় ফোঁটা ফুল সবার জন্য উন্মুক্ত থাকে। সেজন্য সকল বয়সী ছেলে-মেয়েরা বিনা অনুমতিতে ফুল সংগ্রহ করতে পারে। অনেকে আবার বিনা অনুমতিতে ফুল তোলাকে ফুল চুরি করা বলতে প্রয়াস পান; যা অত্যন্ত লজ্জাজনক। যে সময়টাতে বিনা অনুমতিতে ফুল তোলা বৈধ (ঐতিহ্যগতভাবে) তা মোটেই চুরি হতে পারে না। বুনো ফুলের মধ্যে ভাতঝরা ফুল আর বাড়ির আঙ্গিনায় উৎপাদিত দেশি-বিদেশী ফুলের মধ্যে কাঠগোলাপ (বক ফুল), জবা, গোওই ফুল ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। বিঝু আসলে ‘বিঝুফুল’ এর নাম মুখে মুখে উচ্চারিত হয়, প্রকৃতপক্ষে নির্দিষ্ট কোন ফুলকে চাকমারা বিঝুফুল বলে না; কেননা, একেক জায়গায় বিঝুফুল একেক রকম বলে জানে। অনেকে ভেক-ফুলকে বিঝুফুল বলে, অনেকে ভাতঝরা ফুলকে ‘বিঝুফুল’ বলে, আবার অনেকে ছোট ছোট সাদা রঙের সুগন্ধিযুক্ত একপ্রকার ফুলকে বিঝুফুল বলে। একইভাবে বিঝুর সময় আগত পাখিকে বিঝুপেক বলা হয়। প্রকৃতপক্ষে বিঝুপেক কোন পাখির নাম নয়, এটা তার বিশেষিত নাম।
ফুল সংগ্রহের পর একভাগ ঘর সাজানোর জন্য এবং একভাগ গাঙে নিবেদনের জন্য রাখা হয়। যারা সকালে নদীতে ফুল দিতে যায় তারা ছোট ছোট বাচ্চাদের ‘বিঝুগুলো’ খাওয়ার নাম করে নিয়ে যায় এবং গোসল করতে উৎসাহ দেয়। খুব সকালে ছড়ায় অথবা গাঙে অথবা কুয়ার পাশে মোট কথা বিভিন্ন পানির উৎসে মাটির ঢিবি বানিয়ে কলা পাতায় ফুল রেখে গঙা মা’র উদ্দেশ্যে নিবেদন করা হয়। অনেকে বাঁশের কুপি জ্বালায়। বর্তমান সময়ে অবশ্য অধিকাংশই বাঁশের প্রদীপের বদলে মোমবাতি প্রজ্জ্বলন করে। যেই কথা না বললেই নয় তা হলো অতি উৎসাহী হয়ে বিগত কয়েক বছর ধরে অনেকে ঐতিহ্যগত নিয়মে ফুল নিবেদন না করে নদীর জলে ভাসিয়ে দেয়, সেই হিসেবে বলা হচ্ছে “ফুল ভাসানো অনুষ্ঠান”! যার কারণে দেখা দিয়েছে এক হ-য-ব-র-ল অবস্থা। অনেকে হয়ত বলবে সময়ের সাথে অবস্থার পরিবর্তন হয়, অবস্থার পরিবর্তনের সাথে সংস্কৃতিরও পরিবর্তন হয়। তা হয়। কিন্তু আমাদের বুঝতে হবে এই পরিবর্তনে সংস্কৃতির মূলধারা থেকে বিচ্যুত হয়ে পড়ছি কিনা। অতীতের দিকে ফিরে তাকালে আমরা দেখতে পাই, তখন ফুল ভাসানো হতো না বরং ছড়া/গাঙ/কুয়ার ধারে কলা পাতায় করে ফুল দেয়া হতো, যা অত্যন্ত পরিবেশ বান্ধব। অথচ বর্তমান সময়ে দেখা যাচ্ছে- অনেকে ইচ্ছাকৃতভাবে প্লেটে ফুল রেখে জলে ভাসিয়ে দেয়, যা পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর। মিডিয়ায় যেভাবে প্রচার করা হয় তা দেখে যে কেউই ফুল ভাসাতে উৎসাহিত হতে পারে! ফুল হচ্ছে পবিত্রতার প্রতীক। তাহলে ফুলকে বা পবিত্রতাকে ভাসিয়ে দেওয়ার কোনো মানে আছে বলে মনে হয় না। সুতরাং ফুল ভাসানো নয়, ফুল নিবেদনই ফুল বিঝুর তাৎপর্য বহন করে। ফুল নিবেদন হতে পারে প্রিয় কোন মানুষের প্রতি, হতে পারে শ্রদ্ধার পাত্রের প্রতি কিংবা হতে পারে ভক্তিপূর্ণ কোন বস্তুর প্রতি। তবে ফুল বিঝুর দিনে ঐতিহ্যগত নিয়মে গঙা মা’র উদ্দেশ্যে ফুল নিবেদন করা হয়ে থাকে। ফুল বিঝুর দিন ভোরে সচেতনভাবে মাটির ঢিবি বানিয়ে ফুল নিবেদনের পরও হয়ত ফুল ভেসে যেতে পারে পানির ঢেউ কিংবা স্রোতের কারণে। তাতে কিন্তু আপনার আমার হাত নেই। কিন্তু ইচ্ছাকৃতভাবে ফুল ভাসানোকে অবশ্যই ভুল সংস্কৃতি চর্চা বলব। এখন কথা হচ্ছে- যারা গঙা মা’কে কিংবা উপগুপ্ত বুদ্ধকে যারা বিশ্বাস করে না তারা কার উদ্দেশ্যে ফুল নিবেদন করবে? আমার কথা হলো- গঙা মা কিংবা উপগুপ্ত বুদ্ধের প্রতি বিশ্বাস থাকাটা এখানে মুখ্য বিষয় নয়, মুখ্য বিষয় হচ্ছে- পানি যে আমাদের জীবনে অপরিহার্য তার জন্য পানির প্রতি কৃতজ্ঞতা বা শ্রদ্ধা জানানোই মুখ্য। পানির প্রতি আপনার কৃতজ্ঞতাবোধ ও শ্রদ্ধাবোধ থাকলে আপনি পানি ব্যবহারে সচেতন হবেন, পানির উপর প্লাস্টিক, বর্জ্য, পলিথিন জাতীয় পদার্থ বা পানি দূষিত হয় এমন কোন পদার্থ ফেলার সময় অন্তত একবার হলেও ভাবতে বাধ্য হবেন। আর এভাবে সচেতনতা বৃদ্ধির মাধ্যমে ফুল বিঝুর তাৎপর্য বৃদ্ধি পাক এ কামনাই করি।
মুল বিঝু (Mul Bizhu):
বিঝু উৎসবের দ্বিতীয় দিন মুল বিঝু বা মুর বিঝু। মুল বা মুর যাই হোক না কেন এর অর্থ হচ্ছে প্রধান, অর্থাৎ প্রধান বিঝু। মুল ও মুর বিতর্ক সুরাহা করার চেষ্টায় অনেক জনকে প্রশ্ন করেছি, কথা বলেছি। অধিকাংশই যে যেটা বলতে অভ্যস্ত সে সেটাকে সঠিক মনে করে, অপরদিকে যেটাতে অভ্যস্ত নয় সেটাকে ভুল মনে করে। এমন হওয়ার বিষয়টি ধ্বনিতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করা যাক। ল ও র দুটোই হচ্ছে ঘোষ অল্পপ্রাণ ধ্বনি। স্বরধ্বনির তারল্যে উচ্চারিত হয় বলে এ দুটি ধ্বনিকে ‘তরল ধ্বনি’ বলা হয়। এ দুটি ধ্বনি পৃথক স্বনিম/মূলধ্বনি হলেও উচ্চারণের দিক থেকে কাছাকাছি হওয়ায় র্ ও ল্ ধ্বনিতে শ্রুত হয়। তবে, এ ধ্বনিতাত্ত্বিক বিশ্লেষণটি যথার্থ নাও হতে পারে। গঝা ও ভৌগলিক কারণেও এমন ভিন্নতা হতে পারে বলে মনে করি। অনেকে বলছে নতুন প্রজন্মরা নাকি বাংলা শব্দ ‘মূল’ এর অনুকরণে ‘মুল বিঝু’ বলতে অভ্যস্ত হয়েছে, হচ্ছে। তবে, আমি ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে এবং সরাসরি প্রশ্ন করে সিনিয়র অনেককে ‘মুল বিঝু’ বলতে অভ্যস্ত বলে জেনেছি। আমি ‘মুল বিঝু’ লিখছি। মুল বিঝু ছাড়া বিঝু উৎসব আসলে অসম্পূর্ণ। কারণ মুল বিঝুই হচ্ছে বিঝু উৎসবের প্রাণ। মুল বিঝুর সময় সকাল থেকে রাত পর্যন্ত একে অপরের বাড়িতে গিয়ে বিঝুর লবিয়ত (আপ্যায়ন) চলতে থাকে। বিঝুর সময় সকলের মন আনন্দে ভরপুর থাকে। বিশেষ এই দিনে আতিথেয়তার জন্যে নিমন্ত্রণ জানানোর প্রয়োজন পড়ে না, যে যার বাড়িতে যেতে ইচ্ছুক সে ঐ বাড়িতে গিয়ে আতিথেয়তা গ্রহণ করতে পারে। যেখানে ধনী-গরিব, নারী-পুরুষ-তৃতীয় লিঙ্গ, শিক্ষিত-অশিক্ষিত ও বয়সের কোন ভেদাভেদ নেই। মুল বিঝুর দিনে বিভিন্ন খাবাবের মধ্যে সবচেয়ে বড় আকর্ষণ হচ্ছে ‘পাজন তোন’। বাংলায় মিশ্র বা পাঁচমিশালি সবজি তরকারি, ইংরেজিতে Mixed Vegetable Curry । কথিত আছে ২০-১০৮ পদের মিশ্রনে রান্না হয় সুস্বাদু এই পাজন। পাজনে বিশেষ উপাদান হিসেবে থাকে- কাঁঠাল, শুকনো শিমুল ফুল, বনে উৎপন্ন তারা, চেঙেগুলো, শুকনো মাছ প্রভৃতি। এছাড়াও সান্যে পিধে (দলা পিঠা), বরা পিধে (বড়া পিঠা), বিনি পিধে (বিন্নি চালের পিঠা), কলা পিধে (কলা পিঠা) বানানো হয়। আবার কোনো কোনো বাড়িতে (সচরাচর) কিশোর-কিশোরীদের জগরাহ্ ও বড়দের দচুনি নামক পানীয় দিয়েও অতিথি আপ্যায়ন করা হয়। তবে মদ্য-জাতীয় পানীয় পরিবেশনার কোন বাধ্যবাধকতা নেই। খাওয়া-দাওয়া ও নাচ-গানের মাধ্যমে পুরাতন বছরকে বিদায় দিয়ে এ দিনটি পালন করা হয়।
গজ্যেপজ্যে দিন (Gozyepozye Din):
বিঝু উৎসবের তৃতীয় দিন বা শেষ দিন হচ্ছে ‘গজ্যেপজ্যে দিন’। বাংলা ক্যালেন্ডার অনুযায়ী এটি নববর্ষের ১ম দিন। গজ্যেপজ্যে দিনকে আবার গজ্যেপজ্যে বিঝু বলা হয় না। বাংলা নববর্ষের আদলে অনেকে ‘নুও বঝর’ বলে থাকে। অনেকের মতে মুল বিঝুর সময় খাওয়া-দাওয়া ও আনন্দ-ফুর্তির পর বিশ্রামের জন্যে বিছানায় গড়াগড়ি খেয়ে থাকে বলে এদিনটির নাম গজ্যেপজ্যে দিন। অবশ্যই এটি সর্বসম্মত মত নয়। অজ্ঞাত কারণে নামটি গজ্যেপজ্যে দিন হলেও এর সুন্দর বৈশিষ্ট্য রয়েছে। এ দিনে ছোটরা বড়দের গোসল করায় এবং প্রণাম জানাতে ঘরে ঘরে যায় আর বড়রা ছোটদের স্নেহ দানের মধ্য দিয়ে সাধ্যমত খাওয়ায় ও বকশিশ প্রদান করে। পারতঃপক্ষে ছোটরাও বড়দের সম্মানের সহিত কাপড়-চোপড় অথবা অন্য কিছু বকশিশ দেওয়ার চেষ্টা করে। ইদানিংকালে দেখা যাচ্ছে- তরুন তরুনীরা স্বউদ্যোগে তহবিল গঠন করে অর্থ সংগ্রহ করে বয়োজ্যেষ্ঠ ও অস্বচ্ছল মানুষদেরকে বস্ত্র বিতরণ করে, যেটা মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে এসেছে। বৌদ্ধধর্মাবলম্বী চাকমারা এ দিনে বুদ্ধ মূর্তি গোসল/পরিষ্কার করাতে এবং সকাল ও সন্ধ্যায় বুদ্ধের মূর্তির সামনে বাতি জ্বালিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করতে অপেক্ষাকৃত আগ্রহী হয়। অবশ্যই এটি প্রাচীন কোন রীতি নয় বরং বংশ পরম্পরায় প্রচলিত সামাজিক উৎসবের মাঝে ধর্মীয় প্রভাব।
শেষ কথা:
এভাবে আনন্দঘন এ তিনটি দিন উৎযাপনের মধ্য দিয়ে বিঝু উৎসব সমাপ্ত হয়। বিঝুর সমস্ত বিতর্ক নিষ্পত্তি হোক, সঠিক সংস্কৃতি চর্চা হোক। বেগউগুরে, “বিঝু ওহ্ক চাঙমা জাদর দাঙর মেয়েরেগা”𑅁
লেখক: সুজন চাকমা (জুম্মধন)